ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

অনন্য প্রেরণা কিবরিয়া ভাই 

প্রকাশিত : ১৫:৩৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

২৭ জানুয়ারি ২০১৯ শামস কিবরিয়ার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। এ দিনটি সামনে এলে ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতায় অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করে কিবরিয়া ভাইকে নিয়ে। আবেগে আক্রান্ত হই, চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে ওঠে বেদনার অবাধ্য অশ্রু। বহুদিন একসঙ্গে দু`জন কাজ করেছি, পথ চলেছি, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। আজ কিবরিয়া ভাই নেই- ভাবতেই মনটা কেমন করে ওঠে!       

কিবরিয়া ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হতো না- এমন দিনের কথা আমার মনে পড়ে না। দেখাও হতো ঘন ঘন। সেই ১৯৯১ সাল থেকে তার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ক্রমে বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছিল। বইমেলা ২০০৪-এ প্রকাশিত তার বই `চিত্ত যেথা ভয়শূন্য` হাতে তুলে দিয়েছিলেন। শেষবারের মতো হবিগঞ্জ যাওয়ার আগের রাতেও ফোনে আমাদের কথা হয়। আমি কিছুটা অনুযোগ করে বলেছিলাম, অসুস্থ শরীরে এত দৌড়ঝাঁপ না করলে হতো না! তিনি বললেন, `এই তো যাব আর আসব।` `মোনায়েম` বলে ডাকতে পারতেন আমাকে, `তুমি`ও বলতে পারতেন বয়সের কারণে। কিন্তু আমাকে তিনি বরাবরই বলতেন `মোনায়েম সাহেব`। সেদিনও বললেন, নির্বাচনী এলাকায় মাঝেমধ্যে যেতে হয়। সবাই প্রত্যাশা করে আমাকে। স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও চাঙ্গা রাখতে হয়। আর আওয়ামী লীগকে তো আন্দোলন-সংগ্রামেই থাকতে হবে। নির্বাচনই তার একমাত্র পথ। খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন কিবরিয়া ভাই। মনোযোগ দিয়ে অন্যের কথা শুনতেন। সব কাজ করতেন গুছিয়ে। আমি কিছুটা অগোছালো, আবেগপ্রবণ। কিবরিয়া ভাই মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করতেন সংসার করিনি বলে। ভুল-ত্রুটি মার্জনা করতেন। আমিও ভেতরে ভেতরে তার আশ্রয় ও স্নেহের কাঙাল হয়ে পড়েছিলাম। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রে দেশের শত শত বিশিষ্টজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে আমার। কই, কারও সঙ্গে তো এত অল্প সময়ে এত নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি! নিজ গুণে তিনি তার পরিবারের একজন সদস্য করে নিয়েছিলেন আমাকে।

২৭ জানুয়ারি রাত ৮টায় যখন সেই দুঃসংবাদ এলো, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ৩১ জানুয়ারি সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ আয়োজিত সেমিনারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে সেখানে তার মূল প্রবন্ধ পাঠ করার কথা। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করছিলেন। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটা সেমিনারও করি। তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেমিনার পেপার তৈরি করলেন। মস্তিস্ক খুব সক্রিয় ছিল। ওই বয়সেও দ্রুত লিখতে পারতেন কিবরিয়া ভাই। তার ইংরেজি লেখাও ছিল চমৎকার। সারাজীবন ইংরেজি ভাষায় লিখতেন দেশে-বিদেশে। চির অভ্যাসমতো তিনি সেমিনার পেপার ইংরেজিতেই তৈরি করে দিয়ে গেলেন। ফোনে তার সঙ্গে সেমিনারের প্রস্তুতি নিয়েও কথা হলো। কিন্তু সিরডাপ মিলনায়তনে ৩১ জানুয়ারি সেমিনার আর করা হয়নি।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কিবরিয়া ভাইয়ের নেতৃত্বে। তার ইচ্ছায় আমি ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব নিই। ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে অসংখ্য সেমিনার করেছি। মনোগ্রাফ, পুস্তক-পুস্তিকাসহ ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে ফাউন্ডেশন থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর ২২ পর্বের সিডি নির্মিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ প্রকল্পের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজও সম্পন্ন করেছি আমরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের (প্রতিরোধ শিবির, মুজিবনগর সরকার ও শরণার্থী শিবির) ওপর তিনটি থিমেটিক ম্যাপ, আরও কত কী! কত স্মৃতি, কত কথা! ভাবতে গেলে এই বয়সেও বারবার শিশুর মতো কেঁদে উঠি।

সফল আমলার জীবন শেষে ১৯৯১-এ তার আওয়ামী লীগে যোগদানের পেছনে আমারও যৎসামান্য ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা তাকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করতে দ্বিধা করেননি। তিনি সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদের দায়িত্বে আসীন হন তার মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে। ১৯৯৬ ও ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় দলের পক্ষ থেকে মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আমিও নির্বাচন পরিচালনা কাজে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অধিকাংশ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে তার নেতৃত্বেই আমরা গিয়েছি। প্রেস মিট করেছি। দেখেছি তার বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য, বলার ও বোঝানোর ক্ষমতা। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ তাকে অর্থমন্ত্রী বানিয়ে যে ভুল করেনি, গোটা জাতি এখন স্বীকার করে। আমি অর্থনীতি ভালো বুঝি না। কিন্তু কিবরিয়া ভাই যখন বলতেন, পার্লামেন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন কিংবা মৃদুভাষণে বসে বিভুরঞ্জন বা হাসান মামুনকে ব্রিফ করতেন, আমার কাছে খুব সহজবোধ্য মনে হতো।

`মৃদুভাষণ` বের করার সময় তিনি আমার ওপরই নির্ভর করলেন বেশি। বললেন- যাদের নেওয়া হলো, আপনিই তো তাদের ভালো করে চেনেন। আমি হয়তো কাজের মধ্য দিয়ে চিনব। তিনি অল্পদিনেই তাদের চিনলেন, তাদের যোগ্যতায় আস্থা রাখলেন। মৃদুভাষণ অফিসে এলে প্রায়ই আমাকে যেতে বলতেন। বিদেশে গেলে বলতেন, আপনি সব দেখবেন। নিজের চেয়ার দেখিয়ে বলতেন, আপনি এখানে বসবেন। আমি দেখতাম না তেমন কিছুই। যারা কাজ করে, তারাই দেখত। তারাও দ্রুত বুঝে নিয়েছিল তাদের সম্পাদককে। আমি জানি, অমন মর্মান্তিকভাবে তাকে হারিয়ে মৃদুভাষণ পরিবার কতটা বেদনার্ত। প্রিয় সম্পাদককে নিয়েই এখন তাদের লিখতে হচ্ছে। আর আমাকে ৩১ জানুয়ারির সেমিনারটি বাতিল ঘোষণা করে পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছিল।

দারুণ প্রত্যয়ী হয়ে তিনি লিখতেন, বক্তৃতা করতেন। হবিগঞ্জে জীবনের শেষ যে বক্তৃতা করেছেন, তাতেও রয়েছে সেই প্রত্যয়ী মনোভাব। `বাংলাদেশের সামাজিক বিবর্তন কি পশ্চাৎমুখী?` শিরোনামে তার শেষ যে অসমাপ্ত লেখাটি পাওয়া গেছে, তা পড়লে বোঝা যাবে তার উৎকণ্ঠা। দেশের মানুষও তো উৎকণ্ঠিত। মৃদুভাষণ লিখেছে- `উদ্বিগ্ন মানুষের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া হলো না।` কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছি, শামস কিবরিয়ার মৃত্যু গোটা জাতিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তার মতো একজন সজ্জন মানুষকেও যদি এভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে এ দেশে কে নিরাপদ? দেশের ভবিষ্যৎই-বা কী? মেধাবী ছাত্র, রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী- এসব অভিধা ছাড়িয়ে তিনি একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে উদ্বেলিত হয়েছে জাতি ও বিশ্ব জনমত। মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে নেমে এসেছে রাস্তায়। সরব প্রতিবাদও জানানো হয়েছে একের পর এক হরতাল করে। দেশের বিশিষ্টজন নতুন করে নেমে এসেছেন প্রতিবাদে। শাহ এএমএস কিবরিয়ার মতো মানুষের হত্যাকাণ্ডে তারা বুঝতে পেরেছেন, দেশ কোনদিকে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে কান্না। মানুষের শোকে-অশ্রুতে মহীয়ান হয়ে উঠেছে কিবরিয়া ভাইয়ের আত্মদান। আমরা তার প্রিয়জনরাও শোক ভুলে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার অবকাশ পাচ্ছি যেন। কিবরিয়া পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে আসমা ভাবিও আজ প্রয়াত। ড. রেজা ও ড. নাজলী শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশে-বিদেশে যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছে, তা কিবরিয়া ভাইয়ের আপসহীন সংগ্রামী ভূমিকারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। শাহ এএমএস কিবরিয়া স্মরণে দেশে-বিদেশে শোক সভা, প্রতিবাদ সভা, সমাবেশ, মিছিল, হরতাল, মৌন মিছিল, রক্তের অক্ষরে শপথের স্বাক্ষর অভিযানে লাখ লাখ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে। সর্বোপরি গ্রেনেড হামলায় কিবরিয়া ভাই নিহত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে পত্রপত্রিকায় ও সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ যেসব সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন, তার সংখ্যা আমার সংগ্রহেই রয়েছে দুই শতাধিক।

কিবরিয়া ভাই আদর্শ ও লক্ষ্যে ছিলেন অচঞ্চল। কি দেশে, কি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার মেধা, প্রজ্ঞা ও গুণের কথা কারও অবিদিত নয়। কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ এই ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব বোদ্ধা নারী-পুরুষের মনে চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। উত্তর আকাশের উত্তর মেরুবিন্দুর নিকটতম নক্ষত্র ধ্রুবতারার মতো তার স্থির অবস্থান। সমাজ ও মানুষকুলের জন্য এক অনন্য প্রেরণা। অথৈ সমুদ্রে দিকহারা নাবিক অথবা গভীর অরণ্যে পথহারা পথিক যেমন ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে সঠিক দিক নির্ণয় করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়, তেমনি ধ্রুবতারাসম কিবরিয়া ভাইয়ের লক্ষ্য ও আদর্শ আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ২০০৫-এর সূচনায় প্রিয় কিবরিয়া ভাইয়ের মৃত্যু, ক্ষণজন্মা কিবরিয়ার আত্মদান জাতিকে স্বাধীনতার মূলধারায় অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পুনঃস্থাপনে শক্তি জোগাবে- এ বিশ্বাসই এখন আমাদের পথ দেখাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন। এই সরকারের আমলে জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পৃথিবীব্যাপী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা চাই, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের নৃশংস গ্রেনেড হামলার বিচারের মতো কিবরিয়া হত্যার বিচার করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশে অনন্য নজির সৃষ্টি করবে।

গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী

এসি

   


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি